জনমত জরিপে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ২০ বাঙ্গালির তালিকায় ৮ম স্থান অধিকারী করেছেন এমন একজন ব্যক্তি যাকে আধুনিক বাংলা ভাষার জনক বললে হয়ত ভুল হবে না । ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, যিনি বিদ্যাসাগর নামেই পরিচিত । তিনি শুধু বাংলা ভাষাকেই মুক্ত করে জনগণের হাতে তুলে দেননি, তিনি ছিলেন বাংলা শিক্ষা ব্যবস্থার তথা বাঙালি সমাজের ব্যাপক এবং প্রগতিশীল সংস্কারের একজন অগ্রদূত । 
 
short-biography-of-ishwar-chandra-vidyasagar-contributions-quotes
Image from wikimedia

বিদ্যাসাগর বাঙালি সমাজের যে মূল দৈন্যগুলো ছিল যার অনেকগুলো এখনো আছে সেগুলো ঘুচাতে আজীবন চেষ্টা চালিয়ে গেছেন । তাঁর মেধা, ধৈর্য ও চরিত্রের একাগ্রতার কারণে তিনি অসামান্য সাফল্য পেয়েছিলেন । তার অর্জন যেমন শিক্ষার বিস্তার বিশেষ করে নারী শিক্ষা বিধবা বিবাহের প্রচলন, বাল্য বিবাহ রোধ, সংস্কৃত ভাষার কঠিন দেয়াল ভেঙে বাংলা ভাষাকে অবমুক্ত করা এবং গতি দেওয়া এসবগুলোই আজ সমাজ সংস্কারকদের জন্য প্রেরণার উৎস । 
 
কলকাতার মোদিনীপুর জেলায় বিদ্যাসাগর জন্মগ্রহণ করেন ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরে । বাবার নাম ঠাকুরদাস বন্দোপাধ্যায় এবং মা ভগবতী দেবী । গ্রামের পাঠশালা শেষ করে তিনি কলকাতায় পড়াশুনা করতে যান । তিনি ৫২ মাইল পায়ে হেঁটে কলকাতায় যান । সংস্কৃত কলেজ থেকে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করে বিদ্যাসাগর উপাধি নিয়ে বের হন ১৮৪১ সালে ।
 
তারপরই তাকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে হেড পন্ডিত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় । এরপর তিনি সংস্কৃত কলেজে যোগ দেন । কিছুদিনের  মধ্যেই তিনি ওই কলেজের অধ্যক্ষ হন । শিক্ষার ব্যাপারে মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা চালু  করা এবং একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যক্রম তিনি তৈরি করেছিলেন । ৬ মাসের মধ্যে মেয়েদের জন্য তিনি প্রায় ৪০ টি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি সারাজীবন চেষ্টা করে গেছেন । তিনি সাওঁতাল ও দরিদ্র্যদের মধ্যে বিনা পয়সায়  হোমিও চিকিৎসা করতেন । তিনি সেক্যুলারিজমের প্রাণপুরুষ ছিলেন । তার ধর্ম ছিল রিলিজিয়ন অব হিউম্যানিটি । 
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তার জীবন কালে ৩২ টি গ্রন্থ করচনা করেন । এর অধিকাংশই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংস্কৃত, হিন্দি ও ইংরেজি গ্রন্থের অনুবাদ । তার একমাত্র পান্ডিত্যপূর্ণ রচনা হল সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃতি সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব । তার রচনাসমূহের মধ্যে বেতাল পঞ্চ বিংশতি, মহাভারত উপক্রমনিকা প্রভৃতি উল্লেখ্যযোগ্য । তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় বিপত্নীক ছিলেন । তিনি একাই হয়ে উঠেছিলেন একটি ইনস্টিটিউশন । তিনি ছিলেন অনন্য ও অসাধারণ ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রচিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থবলি হচ্ছে- বর্ণপরিচয়, ঋজুপাঠ, সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা, ব্যাকরণ কৌমুদী , শকুন্তলা ইত্যাদি।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কয়েকটি উক্তি ও বাণী সমূহ : 

১. যে ব্যক্তি শ্রমবিমুখ হইয়া  আলস্যে কালক্ষেপ করে তাহার চিরকাল দুঃখ ও চিরকাল অভাব থাকে ।
২. বিদ্যা হলো সব থেকে বড় সম্পদ, বিদ্যা শুধু আমাদের নিজেদের উপকার করে না প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে গোটা সমাজের কল্যাণ সাধন করে ।
৩. কোন বিষয়ে প্রস্তাব করা সহজ, কিন্তু নির্বাহ করে ওঠা কঠিন ।
 
৪. আমি দেশাচারের দাস নহি । নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিত বা আবশ্যক রোধ হইবে, তাহা করিব - লোকের বা কুটুম্বের ভয়ে কদাচ সঙ্কুচিত হইব না ।

৫. যাহার যে অবস্থা, সে যদি তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকে, তাহা হইলে তাহাকে কাহারও নিকট অপদস্থ ও অপমানিত হতে হয় না ।
 
৬. একজন মানুষকে তখনই সর্ব শ্রেষ্ঠ কৃতিত্বের অধিকারী বলা যায় যখন সে অন্যের কল্যাণ কর্মের জন্য কিছুটা সময় অতিবাহিত করতে পারে ।

৭. আমার মা আর বাবািই আমার কাছে কাশীর বিশ্বেশ্বর ও অন্নপূর্ণা ।

৮. মাতা পিতার সেবাই শ্রেষ্ঠ পূজা এবং সন্তানের সর্ব প্রধান ও পবিত্রতম কর্তব্য ।

৯.  বিধবা বিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম । এজন্মে যে ইহা অপেক্ষা অধিকরত আর কোনও সৎকর্ম করিতে পারিব তাহার সম্ভাবনা নাই । এ বিষয়ের জন্য সর্বস্বান্ত হইয়াছি এবং আবশ্যক হইলে প্রাণান্ত স্বীকারেও পরাংমুখ নহি ।

১০.  চোখের সামনে মানুষ অনাহারে মরবে, ব্যাধি, জরা, মাহামারীতে উজাড় হয়ে যাবে,  আর দেশের মানুষ চোখ বুজে ভগবান ভগবান করিবে এমন ভগবত প্রেম আমার নাই । আমার ভগবান আছে মাটির পৃথিবীতে, স্বর্গ চাই না, মোক্ষ চাই না... ।

১১. মানুষ ততই বড় হয়ে যাক না কেনো তাকে সর্বদা তার অতীত কে মনে রাখা দরকার, অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যত এর দিকে এগিয়ে যাওয়া দরকার ।

১২. শিক্ষকের দায়িত্বপূর্ণ কর্তব্যভার গ্রহণ করিতে পারে এমন একদল লোক সৃষ্টি করিতে হইবে; তাহা হইলেই আমাদের উদ্দেশ্য সফল হইবে । মাতৃভাষায় সম্পূর্ণ দখল, প্রয়োজনীয় বহুবিধ তত্ত্বে যথেষ্ট জ্ঞান, দেশের কুসংস্কারের কবল ইহতে মুক্তি...শিক্ষকদের এই গুণগুলি থাকা চাই । এই ধরনের দরকারি লোক গড়িয়া তোলাই আমার সংকল্প ।

১৩. ...সম্পতি আমাদের দেশে, বিশেষ করে কলকাতায় ও তার আশে পাশে পন্ডিতদের মধ্যে একটা অদ্ভুত মনোভাব পরিস্ফুট হয়ে উঠছে । শাস্ত্রে যার বীজ আছে, এমন কোনো বৈজ্ঞানিক সত্যের কথা শুনলে সেই সত্য সম্মন্ধে তাহার শ্রদ্ধা ও অনুসন্ধিৎসা জাগা দূরে থাক, তার ফল হয় বিপরীত । অর্থাৎ সেই শাস্ত্রের প্রতি তাদের বিশ্বাস আরও গভীর হয় এবং শাস্ত্রীয় কুসংস্কার আরও বাড়তে থাকে । তাঁরা মনে করেন, যেন শেষ পর্যন্ত তাঁদের শাস্ত্রেরই জয় হয়েছে । বিজ্ঞানের জয় হয়নি ।

১৫. নারী জাতি এখনও দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ হিসাবে বিবেচিত, এমনটি হলে সমাজের সার্বিক উন্নতি কখনও সম্ভব নয় ।