নেতৃত্বের সুযোগ প্রতিদিনই আসে । ফলে একজন সাধারণ মানুষও নেতা হওয়ার সুযোগ পায় । কিন্তু তার যদি নেতৃত্ব সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকে , তাহলে সে সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও নেতা হতে পারে না । নেতৃত্বের দক্ষতা প্রশিক্ষণ আর চেষ্টার মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব । মানুষের জীবনে প্রতিদিন হাজির হয় নতুন নতুন সমস্যা । সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে নেতৃত্বের দক্ষতা আরো বৃদ্ধি পায় । ফলে ভবিষ্যতে বড় বড় সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সে আরো দক্ষ হয়ে ওঠে । একসময় সে আত্মবিশ্বাসের সাথে দায়িত্ব গ্রহণে এগিয়ে আসে । কারণ যোগ্য নেতা হতে গেলে দায়িত্ব তো নিতেই হবে । আর দায়িত্বের সাথে আসে প্রচন্ড মানসিক চাপ, অস্থিরতা ও দুশ্চিন্তা । দায়িত্ব পালনের পর প্রত্যেক নেতাই পায় স্বর্গীয় সুখ । সঠিক এবং বাস্তবমুখী নেতৃত্ব অর্জনের জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা আবশ্যক ৷

Image by mohamed Hassan from Pixabay

১. সচেতনতা বৃদ্ধি : 

সফল নেতা হতে গেলে প্রথমেই প্রয়োজন আত্মসচেতনতার উন্নয়ন । সময় নিয়ে নিজের শক্তি আর দুর্বলতাকে বিশ্লেষণ করতে হবে । এটা সফলভাবে করতে পারলে বাড়বে নেতৃত্বের দক্ষতা আর মানুষ চেনার ও বোঝার ক্ষমতা । সোজা কথায় নিজের সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা না থাকলে সফল নেতা হওয়া একটা অসম্ভব ব্যাপার । এ কারণে বহু গুণ থাকা সত্ত্বেও অনেক দক্ষ মানুষ নেতা হতে পারে না । নেতৃত্বের সম্মানটা অর্জন করতে হয় , জোর করে আদায় করা যায় না । জালিয়াতি আর মিথ্যার মাধ্যমে নেতা হওয়া যায় এবং এরকম উদাহরণ ইতিহাসের পাতায় অনেক পাওয়া যাবে । ইতিহাস আমাদের আবার এটাও দেখিয়ে দেয় যে , এ ধরনের নেতৃত্ব শুধু একটা সময়ের জন্য টিকে থাকে । তারপর মানুষ তাদের মনে রাখে না । আর একজন সফল নেতাকে মানুষ মনে রাখে অনেক দিন । কারণ মিথ্যার ওপর নির্মিত নেতৃত্ব ক্ষমতাচ্যুত হওয়া মাত্রই হারিয়ে যায় । তাই সফল নেতা হতে গেলে প্রথমেই প্রয়োজন আত্মসচেতনতার উন্নয়ন । এটা করতে গেলে প্রয়োজন নিজের সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা জানতে হবে নেতৃত্বের প্রাথমিক বিষয়গুলো আর অর্জন করতে হবে নতুন জ্ঞান ও দক্ষতা । 

২. মানুষকে বোঝার ক্ষমতা : 

স্বপ্ন , লক্ষ্য , প্রচেষ্টার দিক থেকে বিচার করলে , মানুষের মাঝে লক্ষ্য করা যাবে প্রচুর পার্থক্য । একজন সফল নেতা হিসেবে মানুষের এই নানামুখী বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারটা বুঝার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে । আর এ ফর্মুলার উপর ভিত্তি করেই যুগে যুগে তৈরি হয়েছে সফল নেতৃত্বের । এক দলে নানা গুণের মানুষ থাকে বলেই দলটার শক্তি হয় অনেক বেশি । এটা একজন সফল নেতা হিসেবে উপলব্ধি করতে হবে এবং যত তাড়াতাড়ি এই বোধটা আসবে ঠিক তত তাড়াতাড়িই নেতৃত্বে সাফল্য আসবে । অনেক নেতা আছেন যিনি নিজেকে রহস্যের আড়ালে লুকিয়ে রাখেন । তিনি দেখাতে চান যে , তিনি সবার চেয়ে আলাদা , তার শক্তিই সবচেয়ে বেশি এবং তার কথাই আইন । এ ফর্মুলা হয়তো মধ্যযুগে চলত, এখন মোটেই চলবে না । কারণ মানুষ আগের চেয়ে অনেক শিক্ষিত এবং শিক্ষিত বলেই সে এখন অনেক কিছু বুঝতে পারে । এখন যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে । এসেছে ইন্টারনেট । চালু হয়েছে খোলাবাজার । তাই এখন মানুষ থেকে দূরে থেকে নেতা হওয়া যাবে না । অনুসারীদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে , তাদের কাছাকাছি থাকতে হবে । বোঝাতে হবে তিনিও তাদের মতো একজন সাধারণ মানুষ । এটা করতে পারলে , তাদেরকে অনুপ্রাণিত করা যাবে । 

৩. ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব : 

এটাকে সফল নেতৃত্ব অর্জনের তৃতীয় ধাপ বলা যায় । নেতৃত্ব হাতে আসলে আসবে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব । ক্ষমতা কথাটার মাঝেই লুকিয়ে আছে একটা মোহ । এই মোহ ত্যাগ করতে হবে । ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে হবে সুচিন্তিতভাবে যাতে দেশের বা দলের সবার মঙ্গল হয় । সাধারণত দেখা যায় , নেতা ক্ষমতায় গিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে । এটা এত বেশি ঘটেছে যে , নেতার উপর থেকে সাধারণ মানুষের আস্থা উঠে গেছে । এই জাতীয় নেতার স্থান ইতিহাসের পাতায় থাকে না । যদিও থাকে , তাহলে সেটা থাকে একজন বাজে নেতার উদাহরণ দেওয়ার জন্য । গণতান্ত্রিক নেতৃত্বে নেতা তার অনুসারীদের প্রত্যেকের মতামতের মূল্য দেয় । এই ব্যবস্থায় , যখন অনুসারীদের কারো কোনো ত্রুটি নেতার নজরে পড়ে , তখন তিনি সেটা শুধরে দেয়ার চেষ্টা করেন । তাদের জন্য তৈরি করেন আলাদা সুযোগ । ফলে দেশ বা দলের শক্তি বাড়ে , সেই সাথে নেতার জনপ্রিয়তা ও ক্ষমতা বাড়ে । 

৪. যোগাযোগ : 

মানুষের কর্ম এবং সামাজিক রূপান্তর যোগাযোগের উপর নির্ভর করে । যোগাযোগের মাধ্যমে আবেগ , ধারণা , সম্পদের লেনদেন সহজ হয় । একজন নেতাকে এসব উপাদান নিয়ে কাজ করতে হয় । তাই তাকে একজন দক্ষ যোগাযোগ কর্মীও হতে হবে । কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থার অবনতি ঘটলে , নেতা ও অনুসারীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে সন্দেহ আর ভুল বোঝাবুঝি । এই ব্যবস্থায় একজন নেতা তার অনুসারীদের কাছ থেকে তথ্য গ্রহণ ও প্রদান করে । আবার এর উল্টোটাও ঘটে । সফল নেতৃত্বের জন্য দুটোই দরকার আছে । 

Image by GraphicMama-team from Pixabay

৫. সিদ্ধান্ত গ্রহণ : 

এটাকে বলা যেতে পারে নেতৃত্ব অর্জনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ । নেতা একাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন অথবা দলের সবার সাথে আলোচনা করে  সিদ্ধান্ত নিতে পারেন । উভয় ক্ষেত্রেই প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস । যখন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেল , তখন কাজে নামার নির্দেশটা আসবে নেতার কাছ থেকে । সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় পুরো বিষয়ের উপর মোটামুটি জ্ঞান থাকতে হবে । এই জ্ঞান না থাকলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ঠিক হবে না । অগ্রাধিকার ভিত্তিক সমস্যা ভাগ করতে হবে । তারপর যেটার সমাধান সবচেয়ে আগে প্রয়োজন , সেটার দিকে প্রথমে নজর দিতে হবে । কিছু কিছু সিদ্ধান্ত সাথে সাথে নিতে হয় , যদিও এটা দীর্ঘ সময়ের জন্য জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণও নয় । আবার কিছু কিছু অতি প্রয়োজনীয় ব্যাপার আছে যা ছোট - খাটো সমস্যার চাপে চাপা পড়ে যায় । অনেক সিদ্ধান্ত আছে যা জরুরি কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নয় । এসব সমস্যা অনেক সময় নষ্ট করে ফেলে । তখন নেতাকে আবার সিদ্ধান্ত নিতে হয় , সেই সাথে পুরনো সিদ্ধান্তটাও ঠিক রাখতে হয় । ব্যাপারটা জটিল এবং এর জন্য দরকার সফল নেতৃত্বের । তাই তাকে যাবতীয় সমস্যাকে দুই ভাগে ভাগ করতে হয় । একটা জরুরি এবং আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ । এভাবে সমস্যাগুলো ভাগ করে নিতে পারলে সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হয় । 

৬. কল্পনাশক্তির ব্যবহার : 

কল্পনাশক্তি মানুষকে তার জীবনের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দেয় । যখন এই কল্পনাশক্তি অনুসারীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে , তখন তারা অনুপ্রেরণা লাভ করে । নেতার স্বপ্ন তাদের মাঝে স্বচ্ছ হলেও তারা বুঝতে পারে সাধারণ রুটিন বাধা কাজের বাইরে আছে জীবনের আরেক মানে । অনেক নেতা আছেন যারা অনুসারীদের স্বপ্ন দেখিয়ে প্রচুর অনুপ্রেরণা যোগান যা টাকা - পয়সা আর সম্পদের লোভ দেখিয়েও করা যায় না । স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের নেতারা আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন , তাই আমরা স্বাধীন হতে পেরেছি । আর স্বপ্ন দেখাতে হলে দরকার কল্পনাশক্তির । তাই সফল নেতৃত্ব অর্জন করতে হলে কল্পনাশক্তি একান্তই প্রয়োজন । এর কোনো বিকল্প নেই । স্বপ্ন দেখিয়ে মানুষকে এক করা যায় । এর প্রমাণ ইতিহাসে অনেক আছে । উদাহরণ হিসেবে ফরাসি বিপ্লবের কথা বলা যায় । এখানে মনে রাখা দরকার যে , কল্পনাশক্তির বলেই একজন সাধারণ শাসক অথবা ব্যবস্থাপক একজন সফল নেতায় পরিণত হন । কল্পনাশক্তিই মানুষকে বর্তমানের ‘ ইনফরমেশন সুপারহাইওয়ে’তে নিয়ে এসেছে । কোনো সাধারণ নেতার পক্ষে এটা সম্ভব ছিল না । তাই যুগে যুগে নেতাদের দেখানো স্বপ্ন মানুষকে পথচলার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে । 

৭. নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ : 

এটা আসলে নেতৃত্বের কোনো ধাপ নয় । পূর্বের ধাপগুলো অতিক্রম করতে পারলে এটা অর্জন করা সম্ভব । নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ আসলে পূর্বের ধাপগুলোর যোগফল । সফল নেতৃত্ব অর্জন করতে পারলে , নেতাকে তো সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতেই হবে । এটাই তো একজন সফল নেতার আসল উদ্দেশ্য ।