মরমি সাধক বাউল লালন শাহ  'লালন শাহ' বা 'লালন ফকির' নামে তিনি সমধিক পরিচিত । ফকির লালন শাহ ছিলেন এক সাধারণ শ্রেণী থেকে উঠে আসা এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব । তিনি তার সৃষ্টির মধ্য দিয়ে মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন । তার অসাম্প্রদায়িক চেতনা সবাইকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করে । তিনি জাত , ধর্ম ও বর্ণের উর্ধ্বে উঠে তার সৃজনশীলতা দিয়ে মানুষকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন । তিনি বাংলা ও বাঙালি লোকজ সংস্কৃতিকে সবার সামনে একেবারে সহজ ও সাবলীলভাবে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন যা অন্য কেউ পারেননি । 

short-biography-of-baul-lalon-shah-in-bangla
Md. Saiful Aziz Shamseer, CC BY-SA 3.0 , via Wikimedia Commons

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও অনেক ক্ষেত্রে বাউল লালন ফকিরের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন ।

লালন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন:

১৭৭৪সালে বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার ভারারা গ্রামে লালন জন্মগ্রহণ করেন । সম্ভ্রান্ত হিন্দু কায়স্থ পরিবারের মাধবগড় ও পদ্মাবতীর একমাত্র সন্তান ছিলেন তিনি । শৈশবে পিতৃবিয়োগ হওয়ায় অল্প বয়সে তার ওপর দায়িত্ব এসে পড়ে সংসারের ইতিমধ্যে তিনি বিয়েও করেন । প্রতিবেশী বাউল দাসের সঙ্গে অন্যান্য সঙ্গীসহ একদিন গঙ্গাস্নান মতান্তরে তীর্ণ ভ্রমণ সেরে গৃহে ফেরার পথে তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন । রোগ বৃদ্ধি পেলে অচেতন লালনকে মৃত ভেবে সঙ্গীরা তাকে খুব তড়িঘড়ি করে কোনো রকমে মুখাগ্নি করে নদীতে ভাসিয়ে দেয় । এক মুসলমান রমণী নদীর তীর থেকে সংজ্ঞাহীন লালনকে উদ্ধার করেন । তার সেবায় পালন রোগমুক্ত হন । কিন্তু তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায় । এরপর গৃহে ফিরে এলে সমাজপতি ও আত্মীয় - স্বজনরা মুসলমানের গৃহে খাদ্য গ্রহণের অপরাধে এবং পারলৌকিক অনুষ্ঠানাদি সম্পন্নের কারণে তাকে সমাজে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায় ।

প্রত্যাখ্যাত, ব্যথিত ও অভিমানক্ষুব্ধ লালন এরপর চিত্তরে গৃহ ত্যাগ করেন । সমাজ সংসার , শাস্ত্রাচার ও  জাতধর্ম সম্পর্কেও বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন । এখান থেকেই তার নবজন্য এবং বৈরাগ্য ভাবের উদয় হয় ।বাউলগুরু সিরাজ সাঁইয়ের কাছে দীক্ষা গ্রহণের পর ছেউড়িয়া গ্রামে আখড়া স্থাপন করে তার প্রকৃত সাধক জীবনের সূচনা হয় ।

‘যা আছে ভান্ডে , তা - ই আছে ব্রহ্মান্ডে’-এ ছিল লালনের দর্শন । বৈষ্ণব সহজিয়া , বৌদ্ধ সহজিয়া ও সুফিবাদের সংমিশ্রণে মানবগুরুর ভজনা ও দেহকেন্দ্রিক গুরুমুখী “ সাধনাই লালন প্রদর্শিত বাউল ধর্মের মূলমন্ত্র । ধর্ম, জাতপাত ইত্যাদি নিয়ে লালন তৎকালীন সমাজের জাতপাত ও ধর্ম - বর্ণ বিভেদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন । তিনি জাত , ধর্ম - বর্ণ , গোত্রহীন একটি সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন । তিনি শুধু জাতপাতের বিরুদ্ধেই সোচ্চার ছিলেন না , সামাজিক অনাচার , বিভেদ বৈষমা এবং সামন্ত শোষণের বিরুদ্ধেও কে দাঁড়িয়েছিলেন । লালন গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী বলেন , শিলাইদহের জমিদাররা যখন প্রজাপীড়ন আরম্ভ করলেন, তখন কুমারখালীর কাঙাল হরিনাথ তার গ্রামবার্তা প্রকাশিকায় ঠাকুর জমিদারদের বিরুদ্ধে খবর প্রকাশ করেন । এতে ঠাকুর জমিদাররা কাঙাল হরিনাথকে শায়েস্তা করার জন্য গুণ্ডা নিয়োগ করে । লালন ফকির তখন বন্ধু হরিনাথকে রক্ষার জন্য তার শিষ্যদের নিয়ে জমিদারদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন । এভাবে তিনি তার সমকালের সমাজ শোষণের বিরুদ্ধে , সামস্ত শোষণের বিরুদ্ধে , সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে , সামাজিক ভেদ বিভেদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন । 

সর্বোপরি তিনি এসবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে একটি অখন্ড মানবমণ্ডলী গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন । এভাবে লালন সমকালে নিজেকে সমাজবিদ্রোহী ও ভাববিদ্রোহী এক মরমি সাধক হিসেবে বিকশিত করেছিলেন । ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর , বঙ্গাব্দের ১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক শুক্রবার ভোর ৫ টায় ১১৬ বছর বয়সে মরমি আত্মভোলা এ বাউল সাধক ছেউড়িয়ার আখড়ায় দেহত্যাগ করেন ।

রেফারেন্স : 

https://en.wikipedia.org/wiki/Lalon

https://en.banglapedia.org/index.php/Lalon_Shah

https://bn.wikipedia.org/wiki/লালন