শিশুর আচরণে পরিবর্তন আনুন বিজ্ঞানসম্মত ৫টি উপায়ে

সূচিপত্র:

ভূমিকা

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বয়সের মানুষের উপর বছরের পর বছর গবেষণা করে বের করা হয়েছে, কিভাবে মূলত মানুষের আচরণ পরিবর্তন করা সম্ভব হয়। এই গবেষণাগুলোর ভিত্তিতে যে ৫টি ধাপ তৈরি করা হয়েছে, সেগুলোকে বলা হয় '5 Levers of Behavior Change' বা 'আচরণ পরিবর্তনের পাঁচ স্তম্ভ'।

ছোটবেলা থেকেই সন্তানের মধ্যে যেকোনো ভালো আচরণ বা অভ্যাস গড়ে তুলতে চাইলে এই ৫টি স্তম্ভ বা ধাপ অনুসরণ করাই সবচেয়ে কার্যকর। একটি শিশুর মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে চাইলে শুধুমাত্র বললেই হবে না—ধীরে ধীরে, বুঝিয়ে, দেখিয়ে এবং অভ্যাসে রূপান্তর ঘটিয়ে তবেই তা সম্ভব।

 

একজন খুশি শিশু ভালো অভ্যাস শেখার সময়, পাশে সাহায্য করছেন এক অভিভাবক — দাঁত ব্রাশ করা, খেলনা গুছিয়ে রাখা ও সাহায্য করা, সাথে আচরণ পরিবর্তনের ৫টি ধাপ চিত্রিত
AI-generated image from Fotor

১. কারণ বুঝাই – কেন করা প্রয়োজন? করলে কী লাভ?

শিশুরা যখন কোনো কাজের কারণ বুঝতে পারে, তখন তা করতে তাদের আগ্রহ বাড়ে। শুধু আদেশ দিয়ে বললে শিশু মানতে চায় না। বরং তাকে যদি বোঝানো যায় যে এটি করলে তার বা অন্যের উপকার হবে, তাহলে সে নিজের থেকেই আগ্রহী হয়ে ওঠে।

উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনি চান আপনার সন্তান প্রতিদিন দাঁত মাজুক, তাহলে শুধু "দাঁত ব্রাশ করো" বলার বদলে বলা যেতে পারে, "প্রতিদিন দাঁত ব্রাশ করলে দাঁত ভালো থাকবে, ব্যথা হবে না, আর চকলেটও খেতে পারবে।" এতে শিশুর ভেতর একটি উদ্দেশ্যপূর্ণ ধারণা তৈরি হয়।

 

২. সহজ করি – কি করতে হবে? কীভাবে করতে হবে?

অনেক সময় শিশুরা ঠিক কী করতে হবে, তা না বোঝার কারণে কাজটি করে না বা ভুল করে। তাই দ্বিতীয় স্তম্ভটি হলো – কাজটি তাদের জন্য সহজ করে দেওয়া এবং ধাপে ধাপে দেখিয়ে শেখানো।

ধরুন, আপনি চান আপনার সন্তান প্রতিদিন ঘর গোছাক। যদি আপনি তাকে বলেন, “তোমার ঘর পরিষ্কার করো,” তাহলে সে বুঝতে পারবে না কোথা থেকে শুরু করবে। এর পরিবর্তে, কাজটিকে ছোট ছোট ধাপে ভাগ করে দিন। যেমন, “প্রথমে খেলনাগুলো বাক্সে তুলে ফেলো, তারপর বইগুলো তাকে রাখো।” তাহলে শিশুরা তা সহজেই অনুসরণ করতে পারে। সহজ পদক্ষেপের মাধ্যমে শিশুরা আত্মবিশ্বাস অর্জন করে এবং নতুন আচরণ গ্রহণ করতে উৎসাহিত হয়।

 

৩. মজার ও আকাঙ্ক্ষিত করি – হাতে-কলমে শেখাই, প্রাপ্তি শেয়ার করি

শিশুদের শেখাতে গেলে সেটি যেন মজার হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি কাজটি করার মাধ্যমে সে কী প্রাপ্তি পাবে, তা চোখে দেখিয়ে দিতে হবে। শিশুরা যা করে আনন্দ পায় এবং যেটা অন্যরা করে, তা-ই তারা করতে চায়।

উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনি চান আপনার সন্তান বেশি করে সবজি খাক, তাহলে সবজি খাওয়াকে একটি খেলায় পরিণত করুন। বলতে পারেন, “দেখো, এই গাজরগুলো খেলে তুমি খরগোশের মতো লাফাতে পারবে!”

কাজটিকে খেলার মতো করে উপস্থাপন করুন। যেমন, ঘর গোছানোকে “ট্রেজার হান্ট” খেলায় পরিণত করুন, যেখানে তারা তাদের জিনিসপত্র “খুঁজে” সঠিক জায়গায় রাখবে।

উদাহরণস্বরূপ, খাওয়ার আগে হাত ধোয়ার অভ্যাস শেখাতে গেলে সেটিকে একটি গেমের মতো করে তুলতে হবে। “চলো দেখি কে আগে হাত ধুয়ে আসতে পারে” – এভাবে বললে তা খেলার মতো হয়ে যাবে এবং শিশুরা আগ্রহ নিয়ে অংশ নেবে।

 

একজন খুশি শিশু ভালো অভ্যাস শেখার সময়, পাশে সাহায্য করছেন এক অভিভাবক — দাঁত ব্রাশ করা, খেলনা গুছিয়ে রাখা ও সাহায্য করা, সাথে আচরণ পরিবর্তনের ৫টি ধাপ চিত্রিত
AI-generated image from Fotor

৪. পুরস্কৃত করি – প্রশংসা করি, স্বীকৃতি ও বাহবা দেই

শিশুরা প্রশংসা পেতে ভালোবাসে। তাই কোনো ভালো আচরণ করলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রশংসা করা জরুরি। এটি হতে পারে মৌখিক – যেমন “তুমি দারুণ করেছো!”,

ধরুন, আপনার সন্তান প্রথমবার নিজে থেকে ঘর গুছিয়েছে। তাকে বলুন, “বাহ! তুমি তো ঘরটাকে এত সুন্দর করে গুছিয়েছো, আমি খুব গর্বিত!”

ছোট ছোট সাফল্যের জন্য প্রশংসা করুন। যেমন, “তুমি আজ নিজে থেকে হাত ধুয়েছো, দারুণ করেছো!” মাঝে মাঝে ছোট পুরস্কার দিন, যেমন একটি স্টিকার, তাদের পছন্দের গল্প পড়ে শোনানো, বা একসঙ্গে খেলার সময়। সবার সামনে তাদের প্রশংসা করুন। যেমন, পরিবারের সদস্যদের সামনে বলুন, “দেখো, আমাদের রিয়া কী সুন্দরভাবে টেবিল গুছিয়েছে!” প্রশংসা এবং পুরস্কার শিশুদের মনে ইতিবাচক অনুভূতি তৈরি করে এবং তারা সেই আচরণ বারবার করতে চায়।

 

৫. অভ্যাস বানাই – ২১ দিন একটানা করি, পর্যবেক্ষণ করি

শেষ ধাপটি হলো, শেখানো আচরণটিকে অভ্যাসে পরিণত করা। গবেষণা বলছে, একটি কাজ যদি অন্তত ২১ দিন একটানা করা হয়, তবে তা ধীরে ধীরে অভ্যাসে পরিণত হয়।

শিশু যখন নিয়মিত সেই আচরণটি করতে শুরু করে, তখন সেটি তার মনের ভিতরে গেঁথে যায়। এর পাশাপাশি পর্যবেক্ষণ করা জরুরি—সে ঠিকভাবে করছে কি না, কোথায় সমস্যা হচ্ছে ইত্যাদি খেয়াল রাখতে হবে।


উপসংহার

শিশুদের আচরণ গঠনের বিষয়টি কখনোই জোর করে চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। বরং ভালো আচরণ শেখাতে হলে এই ৫টি স্তম্ভ ধাপে ধাপে অনুসরণ করলে তা অনেক বেশি কার্যকর ও টেকসই হয়। মনে রাখতে হবে, বুঝিয়ে, সহায়তা করে, মজা দিয়ে, উৎসাহ দিয়ে এবং নিয়মিত অভ্যাস করিয়ে তবেই একজন শিশুর আচরণে দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন আনা সম্ভব।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ