ইংরেজি অভিধান অনুযায়ী ডেঙ্গু শব্দটির প্রকৃত উচ্চারণ হবে ডেঙ্গি । ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ । ডেঙ্গু মশাবাহিত একটি মারাত্মক রোগ । ডেঙ্গু জ্বর দু'প্রকার- ক্লিনিক্যাল ও হেমোরেজিক । ডেঙ্গু রোগের আক্রমণে মানব দেহের রক্তের প্লাটিলেটের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পায় ।  মানব দেহের রক্তে স্বাভাবিক প্লাটিলেটের পরিমাণ প্রতি কিউবিক মিলি মিটারে দেড় লাখ থেকে সাড়ে তিন লাখ ।

dengue-fever-symptoms-causes-and-treatment-in-bengali
Image from PxHere

ডেঙ্গুর তেমন কার্যকরী প্রতিষেধক নেই । এ থেকে বাঁচার উপায় হচ্ছে একে প্রতিরোধ করা । ডেঙ্গু কী ? এডিস মশাবাহিত ৪ ধরনের ভাইরাসের যে কোনো একটির সংক্রমণে যে অসুস্থতা হয় সেটাই ডেঙ্গু । এর সাধারণত দু'টো ধরন রয়েছে । এক . ক্লিনিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর , দুই , হেমোরেজিক ডেঙ্গুজ্বর বা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার । শেষেরটাই সবচেয়ে ভয়াবহ ।

ডেঙ্গু ভাইরাস

ভাইরাসজনিত রোগের সাধারণত কোনো প্রতিষেধক নেই । কোনো কোনো ক্ষেত্রে টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যায় । ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত জ্বর । অন্য সব ভাইরাল রোগের মতো এরও কোনো প্রতিষেধক নেই , টিকাও নেই । লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিয়ে এর মোকাবিলা করা হয় । অন্য ভাইরাল ফিভারের মতো এটিও আপনা - আপনিই সেরে যায় সাত দিনের মধ্যে । তবে মূল ভয়টা হচ্ছে এর পরবর্তী জটিলতা নিয়ে । ডেঙ্গুজ্বর যদি সময়মতো যথাযথভাবে মোকাবিলা করা না যায় তবে রোগীর দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে , দেখা দেয় ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বা রক্তক্ষরণকারী ডেঙ্গুজ্বর ।

ডেঙ্গুর লক্ষণ

মস্তিষ্কেও রক্তক্ষরণ হতে পারে । জ্বর ১০৬ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠতে পারে । হঠাৎ করে জ্বর । কপালে , গায়ে ব্যথা । চোখে ব্যথা , চোখ নাড়ালে বা এদিকে - ওদিকে তাকালে ব্যথা । দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া । পায়খানার সঙ্গে রক্ত অথবা কালো কিংবা লালচে- কালো রঙের পায়খানা এমনকি প্রস্রাবের সঙ্গেও অনেক সময় | রক্ত যেতে পারে । ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার খুবই মারাত্মক ।  রোগীর চোখ লাল হতে পারে এবং ত্বকও লাল হতে পারে ।   । গলা ব্যথা , চরম অবসন্নতা ও বিষাদগ্রস্ততা দেখা দিতে পারে । । রোগীর হাড়ের ব্যথা এত তীব্র হতে পারে যে , রোগীর মনে হয় তার হাড় ভেঙে গেছে । এ জন্য এ জ্বরকে ' ব্রেক বোন ফিভার ' বলা হয়ে থাকে । এক্ষেত্রে অনেক রোগীর মৃত্যু ঘটতে পারে।

dengue-fever-symptoms-and-causes
Mikael Häggström, Public domain, via Wikimedia Commons

ডেঙ্গু হেমোরেজিক ( রক্তক্ষরণ ) জ্বর

রক্ত পরীক্ষার যদি অণুচক্রিকা বা প্লাটিলেট সংখ্যা কমে যায় তবে বুঝতে হবে এটি হেমোরেজিক বা রক্তক্ষয়ী জ্বর । রোগীর শকে চলে যাওয়া বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া , অস্থিরতা , অবসন্নতা পেটে তীব্র ব্যথা , হাত - পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া , ত্বক কুঁচকে যাওয়া , রক্তচাপ কমে যাওয়া কিংবা বেশি বেশি প্রস্রাব হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখামাত্র রোগীকে হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে । পুনরায় রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে । প্রচুর তরল খাবার খাওয়াতে হবে । বিশুদ্ধ পানি প্রচুর পরিমাণে পান করাতে হবে । সেই সঙ্গে প্রস্রাবের পরিমাণ মনিটর করতে হবে । সময়মতো সঠিক ব্যস্থাপনায় ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরও সারিয়ে তোলা যায় । বেশি রক্তক্ষরণ হলে ফ্রেশফ্রোজেন প্লাজমা কিংবা কনসেন্ট্রেটেড প্লাটিলেট অথবা প্রয়োজনে পূর্ণ রক্ত পরিসঞ্চালনের মাধ্যমে চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে ।

চিকিৎসা

সত্যিকার অর্থে ডেঙ্গুর সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই । উপসর্গ অনুযায়ী রোগের চিকিৎসা করা হয় । বেশির ভাগ ডেঙ্গু জ্বরই সাত দিনের মধ্যে সেরে যায় , অধিকাংশই মারাত্মক নয় । প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে পানি , বিশ্রাম ও প্রচুর তরল খাবার । সঙ্গে জ্বর কমানোর জন্য এসিটামিনোফেন ( প্যারাসিটামল ) গ্রুপের ওষুধ । সাধারণ ডেঙ্গুর চিকিৎসা এই । তবে ব্যথানাশক ওষুধ হিসেবে এসপিরিন বা ক্লোফেনাক জাতীয় ওষুধ দেয়া যাবে না । এতে রক্তক্ষরণ বেড়ে যেতে পারে । হেমোরেজিক বা রক্তক্ষয়ী ডেঙ্গু ( যা খুবই কম হয়ে থাকে ) বেশি মারাত্মক । এতে মৃত্যুও হতে পারে । জ্বর , সঙ্গে রক্তক্ষরণের লক্ষণ দেখামাত্র হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে বিশেষ চিকিৎসার জন্য । জ্বর কমানোর জন্য বারবার গা মোছাতে হবে ভেজা কাপড় দিয়ে । এক্ষেত্রে রোগীকে শিরাপথে রক্তের প্লাটিলেট ট্রান্সফিউশন করতে হবে । ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীকে মশারির মধ্যে রাখা জরুরি ।

সতর্কতা ও প্রতিরোধ

ডেঙ্গু মশা , মানে এডিস মশা সকাল - সন্ধ্যা কামড়ায় । অর্থাৎ আধাঘণ্টা আগে এডিস মশা কামড়াতে পছন্দ করে সুতরাং ভোরে সূর্যোদয়ের আধাঘণ্টার মধ্যে এবং সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের দুই সময়ে মশার কামড় থেকে সাবধান থাকতে হবে । সেই সাথে এডিস মশা নির্মূল করে ডেঙ্গুকে প্রতিহত করা যায় যেসব স্থানে এডিস মশা বাস করে সেই সব স্থানের এডিস মশার আবাস ধ্বংস করে দিতে হবে । তাই দিনের বেলা ঘরে যাতে মশা ঢুকতে না পারে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে । জমে থাকা পরিত্যক্ত টায়ার , গাছের কোটর , বাঁশের গোড়ার কোটর পানিতে এরা বংশ বিস্তার করে । ফুলের টব , কৃত্রিম পাড়া ডাবের খোসা , বাসার ছাদ প্রভৃতি স্থানে জমে থাকা পানিতে এদের বংশ বিস্তার ঘটে বলে সেখানটায় মশানিধক ওষুধ ছিটিয়ে দিতে হবে । আর এভাবেই সম্ভব ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা । বাড়ির আশপাশের নর্দমা ও আবদ্ধ জলাশয়ে ওষুধ ছিটিয়ে মশা মারতে হবে ঝোপঝাড় পরিষ্কার করতে হবে । সর্বোপরি জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং মশা ধ্বংসের মাধ্যমে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা সম্ভব ।